ভ্যাক্সিন সম্পর্কে জানা অজানা : ভ্যাক্সিন তৈরির ধাপ সমুহ

এই লেখাটির শেষে আপনি যে যে বিষয়ে জানতে পারবেনঃ
# ভ্যাক্সিন কী
# ভ্যাক্সিন ও ঔষধের মধ্যে পার্থক্য
# ভ্যাক্সিন তৈরির ইতিহাস
# ভ্যাক্সিন কীভাবে কাজ করে
# ভ্যাক্সিন তৈরির ধাপ সমুহ
# ভ্যাক্সিন তৈরি হয় কী দিয়ে
# ভ্যাক্সিন আছে কতটি রোগের
# ভ্যাক্সিন এর প্রভাব

💉 ভ্যাক্সিন কীঃ
মানবদেহে কোন জীবাণু প্রবেশ করলে এর বিরুদ্ধে মানুষ বা পশুর শরীরে ইম্যুনিটি বা নিরাপত্তা সৃষ্টির জন্য কৃত্রিমভাবে যা প্রদান করা হয় তাই হল ভ্যাক্সিন বা টিকা। বসন্ত রোগ সম্পূর্ণভাবে নির্মূল এবং পোলিও হাম বা ধনুষ্টংকার এর মত রোগের প্রায় নির্মূল সম্ভব হয়েছে ভ্যাক্সিনেশন বা টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

💊ভ্যাক্সিন ও ঔষধের মধ্যে পার্থক্যঃ
Vaccine বা টিকাদান রোগ প্রতিরোধ করে, অন্যদিকে মেডিসিন বা ঔষধ রোগ নিরাময় করে। এটি বুঝতে পারলে মানুষ সঠিক উপায়ে ভ্যাকসিন এবং ওষুধ ব্যবহার করতে বুঝবে। মানুষের যে সমস্ত রোগ হলে মারা যেতে পারে বা মারাত্বকভাবে অসুস্থ হয়ে যায় এমন ক্ষেত্রে টিকা আবিষ্কার করতে দেখা গেছে।

আর ‘ঔষধ’ হল অসুস্থ মানুষ বা প্রাণীকে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয় যা রোগজনিত জীবানুকে মেরে ফেলে এবং মানুষ বা প্রাণীকে অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। একটি মানুষ বা প্রাণী একটি রোগের জন্য চিকিৎসা হয়েছে এর অর্থ এই নয় যে তার বা সেই প্রাণীটির আর রোগ হবে না। হ্যা, টিকা দেওয়ার ফলে রোগীর বা কোনও অসুস্থ প্রাণীর ক্ষতি হয় না। এছাড়া ওষুধ এবং ভ্যাকসিনের সাথে যে নির্দেশাবলী সমুহ দেওয়া থাকে তা মনোযোগ সহকারে পড়া খুবই গুরুত্ব বহন করে। কারণ, কিছু ভ্যাকসিন এবং ওষুধ গর্ভবতী প্রাণীদের দেওয়া উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অবশ্যই জরুরী।
🔬ভ্যাক্সিন তৈরির মজার ইতিহাসঃ
তখন খ্রিস্টপূর্ব ৪২৯। ইতিহাসবিদ থুসিডিডেস, যিনি গ্রিসে বসবাস করতেন লক্ষ্য করেন যে এথেন্স শহরে যেসব রোগী বসন্ত রোগে আক্রান্ত হবার পর বেঁচে যাচ্ছে সে সমস্ত মানুষদের আর এই রোগটি হচ্ছে না। এরপর চীনারা সর্বপ্রথম ১০ ম শতাব্দীর শুরুতে টিকা প্রদান এর আদি রুপ Variolation আবিষ্কার করে। এই প্রক্রিয়ায় বসন্ত রোগে আক্রান্তদের দেহের পাঁচড়া হতে টিস্যু নিয়ে সুস্থ মানুষদেরকে এর সংস্পর্শে আনা হত। পরবর্তীতে তুরস্ক এবং ইংল্যান্ডেও ভ্যারিওলেশন বিস্তার লাভ করে। ১৭৯৬ সালে বৃটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার আধুনিক টিকা আবিষ্কার করেন। আর এজন্যে তাঁকে ‘টিকার জনক’ বলা হয়।
টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সব চেয়ে মজার ঘটনাটি হল, ছাত্র অবস্থায় এডওয়ার্ড জেনার লক্ষ্য করেন যে গ্রামিন এলাকায় গোয়াল বা যারা দুগ্ধ দোহন করে তাদের ‘বসন্ত’ রোগটি হয় না, কারণ তারা কাউপক্স রোগে আক্রান্ত। (এ বিষয়টি আপনার কাছে আরো পরিষ্কার হবে ; ভ্যাক্সিন কীভাবে কাজ করে নিম্নে সেটি পড়লেই)। তখন ১৭৯৬ সাল। সে সময়ে তিনি এক গোয়ালিনীর হাতে থাকা একটি ক্ষত স্থানেত পুঁজ নিয়ে ৮ বছর বয়সী এক ছেলের হাতে লেপ্টে দেন এবং এর ৬ সপ্তাহ পর তার শরীরে বসন্ত রোগের জীবাণু প্রবেশ করিয়ে দেন। অবশেষে দেখাগেল শিশুটি বসন্ত বা স্মলপক্সে আক্রান্ত হলনা। জেনার এ বিষয়ে আরো গবেষণা করতে থাকেন এবং ১৭৯৮ সালে তিনি ঘোষণা করেন যে বসন্ত ভ্যাক্সিন শুধু শিশু নয়, যুব-বৃদ্ধ সবার জন্যই নিরাপদ। এর অনেক পরে এসে ১৮৮০ সনে ‘লুই পাস্তুর’ জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করেন। এই জলাতঙ্ক ভ্যাক্সিন আবিস্কারের মাধ্যমে তিনি ভ্যাক্সিন জগতে আমূল এক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে ভ্যাক্সিন তৈরির পথ প্রসস্থ হয়েছে অনেক।

READ MORE  পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, গেজেট, অফিস আদেশ, আইন, বিধি, অধ্যাদেশ কী?

🚑ভ্যাক্সিন তৈরির ধাপ সমুহঃ
এবার জেনে নেওয়া যাক ভ্যাক্সিন তৈরির ধাপ সমুহ। আসলে ভ্যাক্সিন তৈরি এতটা সহজ নয়! ভ্যাক্সিন বা টিকা তৈরির মোট ৬টি ধাপের প্রতিটি ধাপে শতভাগ সফলতা সাথে উত্তির্ন হতে পারলেই কেবল ভ্যাক্সিন আবিস্কারে সফলতা আসে। শুধুমাত্র একটি বা দুটি ধাপে উন্নত হয়েই এই সময়ের মধ্যে বাজারে ভ্যাক্সিন আনতে পারব আমরা, এমন দাবী অযৌক্তিক। অনেক ভ্যাক্সিন তৈরিতে দশ বছর একটানা সময় লেগেও ব্যর্থ হতে হয়।

হ্যা, তবে সাধারনত ভ্যাকসিন তৈরি করতে বার থেকে আঠারো মাস বা তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। কারণ, এই প্রক্রিয়াটা একটু জটিল ও একাধিক ধাপ যুক্ত প্রক্রিয়া । প্রতিটা ধাপের শতভাগ সাফল্যের পর পরবর্তী ধাপটা শুরু হয়। এখানে এক্টা ধাপের আগে আরেকটি ধাপ সামান্য হলেও এগিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এক্টা ধাপ শেষ হলেই তবে আরেকটি ধাপে এগিয়ে যাওয়া যায়। এবার চলুন সংক্ষেপে ভ্যাক্সিন তৈরির ধাপগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।

১.অনুসন্ধান মূলক গবেষণা কালঃ
ইংরেজিতে এই সময়কে বলা হয় Exploratory বা অনুসন্ধান মূলক গবেষণা কাল। এই সময়ে ভ্যাক্সিন তৈরির পরিকল্পনা হয়। এই সময়ে কোন দুর্বলকৃত ভাইরাস কে এন্টিজেন হিসেবে নির্বাচন করা হয়, যা ঐ ভাইরাস কর্তৃক সৃষ্টি রোগকে প্রতিরোধ করতে পারবে।

২.প্রি ক্লিনিকাল স্টেজঃ
এই পর্যায়টি হচ্ছে প্রাণীর উপরে ঔষধ প্রয়োগ কাল। যে প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে, সে প্রতিষ্ঠান কোন জৈব টিস্যু, সেল বা প্রাণীর শরীরে এন্টিজেন প্রয়োগ করে।

এতে যদি প্রাণীটির কোন ক্ষতি হয় বা কোন এন্টিবডি তৈরি না হয় ,তবে গবেষণা এখানেই শেষ। অনেক কোম্পানি এই পর্যায়ে এসে থেমে গেছে। তারা আর এগোতে পারেনি।

৩.ক্লিনিক্যাল উন্নয়ন বা clinical Development:
ক্লিনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এর জন্য গবেষকদের একটি স্পন্সর লাগে, স্পন্সর উক্ত ভ্যাক্সিন এর ক্লিনিকাল টেস্ট এর জন্য সে দেশের ঔষধ প্রশাসন কে অনুরোধ জানায়।

READ MORE  শিক্ষকদের টাইমস্কেল জটিলতা নিরসনের দুটি পথ

এরপর, ঔষধ প্রশাসন রিভিউ বোর্ড গঠন করে তাদের ভ্যাক্সিন এর গ্রহণযোগ্যতা দেখে। রিভিউ বোর্ড যদি তাদের গবেষণাকে যুক্তি গ্রাহ্য বলে মনে করে তবে আবেদন মঞ্জুর করে।

অতঃপর তিনটি ধাপে ক্লিনিকেল টেস্টিং করে।

• ধাপ-১.যারা এই ভ্যাক্সিন নিতে আগ্রহী এমন অল্প সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকের উপর প্রয়োগ করে।

• ধাপ-২.তাদের উপর প্রয়োগের ফলে এর কার্যকারিতা কেমন, এটি দেখে এর এন্টিবডি মাত্রা, ডোজ নির্ধারণ করে।

• ধাপ-৩.এরপর অনেক সংখ্যক সেচ্ছায় টিকা গ্রহনে ইচ্ছুক এমন স্বেচ্ছা সেবকদের উপর ট্রায়াল দেয়া হয়। এরপর এর কার্যকারিতা পুনরায় র্মূল্যায়ন করা হয়।

• ধাপ-৪.ঔষধ প্রসানের কাছে সনদের আবেদনঃ উপরোক্ত তিনটি ক্লিনিক্যাল ধাপ পার হবার পর ভ্যাক্সিন উদ্যোক্তা নিরাপদ বায়োলজি সনদের জন্য ঔষধ প্রশাসনে আবেদন করে।

• ধাপ-৫.ঔষধ প্রস্তুত করনঃ এরপর, ঔষধ প্রস্তুত কারক কোন কোম্পানির সাথে ভ্যাক্সিন উৎপাদন এর জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। অতঃপর চুক্তিবদ্ধ কোম্পানি নিজেদের সকল প্রস্তুতি শেষে ভ্যাক্সিন উৎপাদন শুরু করে।

• ধাপ-৬.মান নিয়ন্ত্রণঃ এরপর, গবেষণা ও প্রস্তুত করণ প্রতিষ্ঠান ভ্যাক্সিন এর সত্যিকার কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মনিটরিং করে। প্রয়োজনে তারা কিছু ফ্রি স্যাম্পল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করে ফলাফল প্রত্যক্ষ করার জন্য। আর এটাকেই চতুর্থ ফেজ ট্রায়াল বলা হয়।

আর এটার মাধ্যমে Vaccine Adverse Event Reporting System বা ভ্যাকসিন প্রতিকূল ইভেন্ট রিপোর্টিং সিস্টেম VAERS এবং Vaccine Safety Datalink তৈরি হয়।

#ভ্যাক্সিন যেভাবে কাজ করেঃ
জীবাণু থেকেই এর দ্বারা সৃষ্ট রোগের ভ্যাক্সিন প্রস্তুত করা হয়। এ ক্ষেত্রে জানা দরকার, যে কোন জীবাণুর আছে দুইটি বৈশিষ্ট্য-
• এক হল রোগ সৃষ্টি করা।
• অন্যটি দেহের অভ্যন্তরে ঐ একই রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য কিছু পদার্থ বা রোগপ্রতিরোধী তৈরী করা।
এক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন তৈরীর সময় রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাটিকে নষ্ট করে দেয়া হয় কিন্তু সেই রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার ক্ষমতাটি টিকিয়ে রাখা হয়। মোদ্দা কথা হল, রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাহীন জীবাণুকেই ভ্যাক্সিন হিসেবে দেহে প্রবেশ করানো হয়। ফলশ্রুতিতে এই জীবাণু দেহে রোগের কারণ হয় না, উল্টো রোগটি যেন না হয় তার জন্য বিশেষ পদার্থ বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী করতে থাকে। আরেকটি সুবিধা হল এই জীবাণুগুলো মেমরি সেল গঠন করে যার ফলে পরবর্তীতে একই জীবাণু পুনর্বার প্রবেশ করলে সহজে সনাক্ত করতে পারে। এভাবে ভ্যাক্সিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়।

READ MORE  বয়সসীমা কত হচ্ছে পলিটেকনিকে ভর্তিতে? কমছে ভর্তি ফি ও শিক্ষাগত যোগ্যতা

#ভ্যাক্সিন ২ ভাবে দেওয়া হয়ে থাকেঃ
ইঞ্জেকশন বা মুখে খাওয়ার মাধ্যমে ভ্যাক্সিন দেয়া যায়।

ভ্যাক্সিনেশন দুই সময়ই দেওয়া হয়-
১. রোগ হবার আগে। ২. রোগ হবার পরে।

ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে যে যে রোগ প্রতিরোধ সম্ভবঃ
২৫ টি রোগের তালিকা করেছে WHO যেগুলোকে ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব সেগুলো হলঃ অ্যানথ্রাক্স, হাম, রুবেলা, কলেরা, মেনিংগোকক্কাল, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডিপথেরিয়া, মাম্পস, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস এ, পারটুসিস, যক্ষা, হেপাটাইটিস বি, নিউমোকক্কাল, টাইফয়েড জ্বর, হেপাটাইটিস ই, পোলিও, টিক-বর্ণ এনকেফালাইটিস, হিমোফাইলাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি, জলাতংক, ভেরিসেলা এবং হার্পিস, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, রোটাভাইরাস, ইয়েলো ফিভার ও জাপানীজ এনকেফালাইটিস।

ভ্যাক্সিনের প্রভাবঃ
২০১২ সালে বিশ্ব WHO এর তথ্য মতে প্রতিবছর টিকা প্রদানের ফলে আড়াই প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। এ ছাড়া আমাদের শিশুদের যেসব রোগের ভ্যাক্সিন দেয়া হয় তা মোটামুটি ৯০-১০০% রোগ প্রতিরোধক।

সূত্রঃ Who, বিকাশ পিডিয়া, Wikipedia.

Leave a Comment