গ্রন্থাগারিক পদে জনবল কাঠামো নীতিমালায় যোগ্যতা জটিলতা এবং সেশনজট

ক্যারিয়ার

দৈনিক বিদ্যালয় । ২০২০ ।

টেকনিক্যাল বা কারিগরি বিষয় বা ক্ষেত্র বলতে সাধারণত সেসব বিষয় বা ক্ষেত্রকে বুঝায় যেখানে কোনো নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন পদ্ধতি শিখানো হয়। অর্থাৎ এরকম শিক্ষা অর্জন করে ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের যোগ্যতা অর্জন করে। এরূপ গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় একটি টেকনিক্যাল বিষয় হলো- ‘লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স’ ডিপ্লোমা কোর্স। বাংলাদেশ একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশ। শিক্ষা ক্ষেত্রে এদেশ খুব দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যুগের পরিবর্তনে উন্নত বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশেও এখন আধুনিক ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি করে গ্রন্থাগার স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, দেশের বহু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও গ্রন্থাগারের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাই গ্রন্থাগারের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য এ বিষয়ে দক্ষ জনবলের প্রয়োজন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে প্রায় লক্ষাধিক প্রতিষ্ঠিত ও সরকার অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। যেগুলোর প্রায় অর্ধেকেও বেশি প্রতিষ্ঠানে এখনো গ্রন্থাগার নেই বা গ্রন্থাগারিক নিয়োগ করা হয়নি। এমতাবস্থায় নিঃসন্দেহে গ্রন্থাগারিক বা সহকারী গ্রন্থাগারিক – খুব সম্ভাবনাময় দুটি পদ।

দেশের স্কুল কলেজ গুলোতে আগে থেকেই পদদুটিতে জনবল নিয়োগ করা থাকলেও বেশিরভাগ মাদ্রাসায় সাম্প্রতিক পদদুটি সৃষ্টি করা হয়েছে। যেখানে উক্ত পদদ্বয়ের জন্য ৮ হাজারেরও বেশি জনবল প্রয়োজন। তাছাড়া দেশে প্রায় ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেগুলোতেও খুব নিকট ভবিষ্যতে গ্রন্থাগার স্থাপন ও জনবল নিয়োগ করার প্রস্তাব সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে বলে ‘লাইব্রেরি এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ -LAB’ এর একাধিক সদস্যের সাথে কথা বলে জানা যায়। সুতরাং ‘লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স’ বিষয়টিতে শিক্ষা অর্জন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উক্ত বিষয়ে শিক্ষালাভ তথা সনদলাভ ছাড়া গ্রন্থাগারিক বা সহকারী গ্রন্থাগারিক হওয়া যায় না। অর্থাৎ উক্ত পদদ্বয়ের প্রধান যোগ্যতাই হলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অর্জিত যোগ্যতা সনদ বা সার্টিফিকেট।

READ MORE  শুধুমাত্র সার্টিফিকেট জমা দিয়ে ১ কোটি টাকা ঋণ নিতে পারবে বেকার যুবকেরা

কিন্তু অতীব সম্ভাবনাময় কর্মসংস্থান ক্ষেত্র হওয়ার পরও উক্ত পদে নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতাও সৃষ্টি হয়েছে।সৃষ্ট জটিলতাগুলোর মধ্য অন্যতম হলো “বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান(মাদ্রাসা) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ ” এ পদদুটির নিয়োগ যোগ্যতায় সমমান না রাখা। পূর্বে মাদ্রাসাসহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য সমমান যোগ্যতার ভিত্তিতে পদদুটিতে জনবল নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু ২০১৮-এর নীতিমালায় মাদ্রাসা অংশে উক্ত পদদ্বয়ের জন্য সমমান যোগ্যতাটি বাতিল করা হয়। অর্থাৎ মাদ্রাসায় সহকারী গ্রন্থাগারিক পদটির জন্য যোগ্যতা করা হয়েছে ফাজিল পাশ বা আরবি বিষয়ে অনার্স এবং গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা। আর গ্রন্থাগারিক পদটির জন্য যোগ্যতা করা হয়েছে কামিল বা আরবি বিষয়ে মাস্টার্স এবং গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা। নীতিমালায় যে বৈষম্য করা হয়েছে তার স্পষ্ট ছাপ হলো এই গ্রন্থাগারিক পদের যোগ্যতা। কারণ গ্রন্থাগারিক একটি উচ্চতর পদ(প্রভাষক পদ মর্যাদার), এর যোগ্যতা শুধু ডিপ্লোমা হতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর /মাস্টার্স ডিগ্রি। অর্থাৎ এর দ্বারা শুধু একটি নির্দিষ্ট পক্ষের জন্য পদটি পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবার গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক উভয়ক্ষেত্রেই গ্রন্থাগার ডিপ্লোমার পাশাপাশি শুধু মাদ্রাসা শিক্ষার ফাজিল, কামিল বা আরবি বিষয়ের যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার গ্রন্থাগার বিজ্ঞান কোর্সধারী জেনারেল শিক্ষিতদের চাকরির নিশ্চয়তা আজ হুমকির মুখে। দেশের মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মাদ্রাসা। তাহলে এই দুটি পদের তিন ভাগের এক ভাগ শুধু মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত হচ্ছে, তাছাড়া তাঁরা দেশের অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো নিয়োগ নিতে পারবেন-ই। তাহলে এই পদ দুইটির বেশির ভাগই মাদ্রাসা শিক্ষিতদের দখলে চলে যাবে। আর দেশের মোট শিক্ষার্থীর ৭০% জেনারেল শিক্ষিত দের এক্ষেত্রে খুব সামান্য সুযোগই রয়ে যাবে। অথচ সকল শিক্ষার্থী ‘লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স’ ডিপ্লোমা কোর্সে সমমানের যোগ্যতায় ভর্তি হন, সবাইকে একই শিক্ষাক্রমের আওতায় একই সিলেবাসভুক্ত বই পড়ানো হয়। সবাইকে একই সনদপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়েছে। এরূপ নীতিমালার পিছনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একটাই যুক্তি শুনতে পাওয়া যায় তা হলো মাদ্রাসা সিলেবাসের আরবি বই। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া দরকার, “লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স” কোর্সের কোথাও আরবিতে ক্যাটালগ পদ্ধতি শেখানো হয়না এবং আরবিতে ক্যাটালগ তৈরীর প্রয়োজনও নেই। তাহলে কেনো এই বৈষম্য সৃষ্টি তা বোধ্যগম্য নয়। তাছাড়া দাখিল-আলিম পর্যায়ের আরবি বইগুলোর কভার পৃষ্ঠায় বাংলায়-ও বইগুলোর নাম ও প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া থাকে যার ফলে একজন জেনারেল শিক্ষিত গ্রন্থাগারিক দ্বারা সহজেই তা ক্যাটালগ ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব। অর্থাৎ মোট কথা আরবি ভাষার পারদর্শিতা এখানে একটি গৌণ ব্যাপার মাত্র। একটি গ্রন্থাগারে বিভিন্ন ভাষার বই থাকতে পারে তবে তার জন্য বিভিন্ন ভাষা বিশারদ গ্রন্থাগারিক বাধ্যতামূলক নয়। আবার গ্রন্থাগারে এমন কিছু প্রাচীন ভাষার বই বা দলিল থাকতে পারে যা পড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

READ MORE  নিবন্ধনধারী চাকুরী প্রত্যাশীদের সতর্ক করল এনটিআরসিএ

সুতরাং একটি প্রতিষ্ঠানের ২০-৩০% (ফাজিল কামিল পর্যায়ে একটু বেশি) আরবি বইয়ের কথা বিবেচনা করে ৭০% এরও বেশি জেনারেল শিক্ষিত দের উক্ত পদদ্বয়ের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা এই ক্ষেত্রটিতে ক্যারিয়ার গড়ার একটি বড় বাধা।

দ্বিতীয়ত- সবকিছু ছাপিয়ে বর্তমানে যে জটিলতাটি বেশি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে নব সৃষ্ট পদে মাদ্রাসায় পদ দুটির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ। এতে একদিকে যেমন সমমান বঞ্চিত জেনারেল শিক্ষিতরা সমমান হারিয়ে দুঃচিম্তায় দিন কাটাচ্ছে অপর দিকে সেশনজটের কারণে আটকে পরা ২০১৮-২০১৯ ও ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের হাজার হাজার শিক্ষার্থী সময় পেড়িয়ে যাওয়ার পরও পরীক্ষা দিতে না পারায় সনদ হাতে পাচ্ছে না। পরীক্ষা না হওয়ায় বা সনদ না থাকায় তারা আবেদনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না, যার ফলে এই শিক্ষার্থীরা যে স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য নিয়ে এই কোর্সে ভর্তি হয়েছিল তা অপূর্ণই থেকে যাবে, কারণ পদগুলো একবার পূরণ হয়ে গেলে আগামী কয়েক বছরেও এতো বড় (প্রায় ৮৫০০+ সৃষ্টপদ) নিয়োগ হবে না। অপর দিকে বয়স সীমা সবোর্চ্চ ৩৫ বছর হওয়ার ফলে অনেকে বয়স নিয়েও শঙ্কিত। এই হাজার হাজার পদের নিয়োগ হয়ে গেলে সেশনজটে থাকা শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
তাই করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া অর্থাৎ সেশনজট সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্তাগারিক পদে নিয়োগ স্থগিত রাখা একান্ত প্রয়োজন।

আরো পড়ুন প্রাথমিকে ২৬ হাজার ও ১৪ হাজারের বিশাল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আসছে

তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষ যদি এরূপ সমস্যা গুলোর সমাধানে এখনি এগিয়ে না আসেন তাহলে ভবিষ্যতে যোগ্য ও মেধাবীরা বিষয়টিতে শিক্ষার্জনে অনাগ্রহী হবে। এতে সামগ্রিকভাবে ক্ষেত্রটির উন্নয়ন ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।

লেখক-মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক, জয়পুরহাট, ডিপ্লোমা-ইন-লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স। শিক্ষাবর্ষঃ ২০১৮-২০১৯, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

READ MORE  নিবন্ধনধারী চাকুরী প্রত্যাশীদের সতর্ক করল এনটিআরসিএ

(ডিবিআবুসি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *