প্যারিসিয়ানের গোলে পিএসজিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ‘অপরাজেয়’ বায়ার্ন মিউনিখ

বিবিধ

মো: লোকমান উদ্দিন | স্পোর্টস রিপোর্টিং ডেস্ক

গল্প ছিল অনেকগুলো। ২২ জনের সবার সঙ্গে সবার লড়াই। যে গল্পটা ম্যাচের আগে কম হলো, সেটাই হয়ে গেল চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের গল্প। দুর্দান্ত প্রথমার্ধের পর ৫৯ মিনিটে গিয়ে ম্যাচের গিঁট খুলল এক প্যারিসিয়ানের গোলে। কিন্তু সেই প্যারিসিয়ান খেলেন জার্মান দলের হয়ে। বায়ার্ন মিউনিখ কোচ ফাইনাল ম্যাচের একাদশে যে একটি পরিবর্তন করেছিলেন তিনিই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। জশুয়া কিমিখের ঝুলিয়ে দেওয়া ক্রস দূরের পোস্টে হেড করতে কিংসলে কোমানকে লাফাতেও হয়নি। এর আগে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চাপে ছিল পিএসজি। বায়ার্ন সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে। কিমিখের ক্রসে কোমানের চোখ জ্বলে উঠেছে, এরপর হেডে গোল করে ফাইনালে পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন সাবেক ক্লাবের বিপক্ষে। নেইমার, এমবাপের স্বপ্নভঙ্গের রাতে প্যারিসের ছেলে স্বপ্নপূরণ করেছেন বায়ার্নের লাল জার্সিতে। তাতে সাত বছর আরেকবার ইউরোপাসেরা বায়ার্ন মিউনিখ। ছয়বার ইউরোপাসেরা হয়ে বায়ার্ন বসেছে লিভারপুলের পাশে। সামনে কেবল এসি মিলান আর রিয়াল মাদ্রিদ।

চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপাটা তাই উঠেছে ম্যানুয়েল নয়্যারের হাতে। সবার আগে শিরোপার দাবিদারটা আসলে তিনিই। দুই অর্ধে দুর্দান্ত দুইটি সেভ করে পিএসজিকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেননি জার্মান গোলরক্ষক। তবে পিএসজিও একটা জায়গায় সরব হতে পারে। ৭৩ মিনিটে একটা পেনাল্টি বোধ হয় প্রাপ্যই ছিল পিএসজির। কিমিখ বক্সের ভেতর পেছন থেকে ট্যাকেল করেছিলেন এমবাপেকে। বল পাননি কিমিখ, পেয়েছিলেন এমবাপের পা। পিএসজির খেলোয়াড়রাও মাঠে আবেদন করেননি তেমন। রেফারির পর ভিএআরও সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কাঁটাছেড়া করেনি।

বায়ার্ন শিরোপা জিতল যোগ্য দল হিসেবেই, পুরো টুর্নামেন্টে ১১ ম্যাচ জিতে। চ্যাম্পিয়নস লিগে এমন রেকর্ড নেই একটিও। এই বায়ার্ন অপরাজেয়ই। ২০১৩ সালের পর আরও একবার ট্রেবল বাভারিয়ানদের ঘরে। হানসি ফ্লিকের বায়ার্ন লিসবন রাঙিয়েছে লাল রঙে, নেইমার-এমবাপেরা ধূসর হয়ে গেছেন তাদের কাছে। এস্তাদিও দা লুজে হতাশার কান্নায় মুখ লুকানোর আগে নেইমাররা অবশ্য প্রথমার্ধে দাপট দেখিয়েছিলেন। ফাইনালের হিসাবে অভিজ্ঞ বায়ার্নের সামনে পিএসজির ওই তেজ টেকেনি। দ্বিতীয়ার্ধের অন্য বায়ার্ন ম্যাচ ছিনিয়ে নিয়েছে পিএসজির কাছ থেকে।

READ MORE  যে কারণে সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের সিদ্ধান্ত

এক গোলের ম্যাচে শেষ পর্যন্তও পিএসজির সম্ভাবনা টিকে ছিল। তৃতীয় দফার বদলিতে তুখলের সিদ্ধান্ত তাতে হয়ত বড় প্রভাব ফেলল। যখন গোল দরকার ছিল তখন মাউরো ইকার্দির বদলে আটালান্টার বিপক্ষে জয়ের নায়ক চুপো মোটিংকে মাঠে নামিয়েছিলেন তুখল। যোগ করা সময়ে গোলের একেবারে সামনে তিনিই সুযোগটা পেয়েছিলেন আরও একবার। নেইমারই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তার পাস থেকে মোটিং পায়ে বল ছোঁয়াতে পারলে হয়ত আরেকবার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারতেন দলের। পারেননি, ম্যাচ শেষে নেইমারের কান্না হৃদয়ভাঙ্গার গল্প বলেছে। তুখলের সিদ্ধান্তকে অবশ্য এর বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ নেই। বায়ার্নের দলীয় শক্তির কাছে ম্লান হয়ে গেছে পিএসজির রথী-মহারথীরা।

বায়ার্নের হাইলাইন আর পিএসজির দ্রুতগতির ফ্রন্টলাইন- ফাইনালের আগে আলচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এগুলোই। বায়ার্ন ঝুঁকি নিল কম। ফ্লিক ম্যাচের আগে বলেছিলেন, হাইলাইনে খুব বেশি পরিবর্তন আনবেন না তিনি। তবে কথা রাখা হয়নি তার। পিএসজির বিপক্ষে সতর্ক হয়েই শুরু করেছিল বায়ার্ন।

ফ্লিকের ওভারট্রাম্প, নয়্যারের শেষ রাতের মার, ফুলব্যাকদের লড়াই : ফাইনালের ব্যবধান গড়ে দেওয়া পাঁচ কৌশল

প্রথমার্ধে ১৮ মিনিটের ভেতর দুইবার বায়ার্নের হাইলাইন ভেঙে বক্সে ঢুকে পড়েছিল পিএসজি। প্রথমবার এমবাপে শট হয়েছে ব্লকড। পরেরবার নয়্যারের পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন নেইমারের সামনে। ম্যাচের মাহাত্ম্য যেমনই হোক, বরাবর মাথা ঠান্ডা তার। এবারও ছিল। এমবাপের পাস থেকে নেইমার বক্সের ডান কোণায় তাকে একা পেয়ে গিয়েছিলেন। নয়্যার পুরো শরীর ছড়িয়ে দিয়ে বাম পায়ে প্রথম সেভ করেছেন, ফিরতি বলেও নেইমারকে আটকে দিয়েছেন।

প্রথমার্ধে গোলের আরও কাছাকাছি গিয়েও খালি হাতে ফিরেছিল বায়ার্ন। লেভানডফস্কি দুর্বল শটও গিয়ে লেগেছিল বারপোস্টে। কেইলর নাভাস একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না, এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক হলে তখনই এগিয়ে যায় বায়ার্ন। খানিক বাদে লেভানডফস্কি আবার হেড করেছিলেন, সে দফায় অবশ্য নাভাস ছিলেন প্রস্তুত।

পিএসজির তিন মিডফিল্ডার দলকে যোগ্য সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন প্রথমার্ধে। পারেদেস, মার্কিনিয়োসদের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল ছিলেন অ্যান্ডার হেরেরা। নেইমারের আরেকটি আক্রমণের পর হেরেরার একটি পাস আনহেল ডি মারিয়াকে ভালো জায়গায় খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু ডি মারিয়া তখন দুর্বল পায়ে মেরেছেন অনেক ওপর দিয়ে। পুরো ম্যাচে ডি মারিয়া এতো ভালো সুযোগ আর পাননি, তৈরিও করতে পারেননি। হেরেরা নিজেও গোলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন বায়ার্নের রক্ষণের কাছে। প্রথম ৪৫ মিনিটে পিএসজির জন্য ম্যাচ শেষে আফসোস হয়ে থাকবে। এমবাপে সিক্স ইয়ার্ড বক্সের মাথা থেকেও বল মেরেছেন সরাসরি নয়্যারের হাতে। এমবাপের হাতে সময় ছিল, সুযোগ ছিল- কোনোটাই কাজে লাগাতে পারেননি তখন। ১১ বার ফাইনাল খেলা বায়ার্ন আর প্রথম ফাইনাল খেলতে নামা পিএসজির পার্থক্য তখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

READ MORE  একজন সাহসী রাজনীতিবিদ

প্রথমার্ধে পিএসজির বেশ কয়েকটি ভালো আক্রমণ, তার সঙ্গে চোটের কারণে জেরোম বোয়াটেংকে হারিয়ে ফেলা, আলফোন্সো ডেভিসের হলুদ কার্ড- বায়ার্ন খানিকটা পিছিয়েই ছিল প্রথমার্ধে। তবে বিরতির ঠিক আগে সেই কোমানই পেনাল্টির আবেদন তুলেছিলেন। বক্সের ভেতর পিএসজির জার্মান ফুটবলার থিলো কেহরার তাকে বাধা দিয়েছিলেন। রেফারি তখনও সাড়া দেননি। দ্বিতীয়ার্ধে বায়ার্ন পুরো চেহারাই পালটে ফেলল। থিয়াগো আলকান্তারা মিডফিল্ডে ওস্তাদি শুরু করলেন পুরোদমে। বায়ার্ন চাপে পড়েও মচকায়নি, কিন্তু ভেঙে পড়ল পিএসজি। অভিজ্ঞতাই তখন বড় হয়ে গেল ম্যাচে। নিজেদের অর্ধ থেকেই বের হতে বেগ পেতে হচ্ছিল তাদের। ৫৯ মিনিটে পরে কোমান পিএসজিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন। ফ্রেঞ্চ কোমানকে আটকানোর দায়িত্ব ছিল জার্মান কেহরের। প্রথমার্ধ কেহরের কিছুটা সুবিধা করতে পারলেও পরের অর্ধে কোমানের কাছে নাকানিচুবানি খেয়েছেন তিনি।

ছন্নছাড়া পিএসজি এরপর বায়ার্নের আক্রমণের স্রোতে ভেসেছে আরও কিছুক্ষণ। কিমপেম্বের দারুণ এক ব্লক আর থিয়াগো সিলভার গোললাইন ক্লিয়ারেন্স তখন আটকে রেখেছিল বায়ার্নকে। খানিকটা সামাল দিয়ে ৭০ মিনিটে মার্কিনিয়োস আরেকবার নয়্যারকে ওয়ান অন ওয়ানে পেয়ে গিয়েছিলেন বক্সের ভেতর। কিন্তু এবারও সেই একই কায়দায় আরেক ব্রাজিলিয়ানকেও হতাশ করেন নয়্যার। শেষদিকে নয়্যার ঠেকিয়েছেন অফসাইডে থাকা এমবাপের শটও। সেটা অবশ্য গোল হলেও বাতিল হত। তবে নয়্যার শুধু নিজের বীরত্ব দেখিয়েছেন আরেকবার। ফিলিপ কৌতিনহো, ইভান পেরিসিচরা পরে বদলি হিসেবে নেমেছিলেন। তাদের স্বপ্নও পূরণ হয়ে গেছে ধারে বায়ার্নের হয়ে খেলতে এসে।

৫০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার ফাইনালে উঠে তাই পিএসজির হার লেখা হয়েছে আরেক প্যারিসিয়ানের কাছে। আর মৌসুমের মাঝপথে কোচ বদলে ফেলা বায়ার্ন ছাই ভস্মে থেকে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে উঠতে সিংসাহনেই বসেছে। এমন দাপুটে চ্যাম্পিয়ন কমই দেখেছে ইউরোপ!

একাদশ

পিএসজি

নাভাস, কেহরের, সিলভা, কিম্পেম্বে, বের্নাট, মার্কিনিয়োস, হেরেরা, ভেরাত্তি, ডি মারিয়া, নেইমার, এমবাপে

বায়ার্ন মিউনিখ

নয়্যার, কিমিখ, বোয়াটেং, আলাবা, ডেভিস, থিয়াগো, গোরেতস্কা, মুলার, গ্যানাব্রি, কোমান, লেভানডফস্কি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *