দৈনিক বিদ্যালয়ঃ
হাওরে করচ গাছ জলের সাথে খেলে, সাথে উদাস বাতাস। সে এক অপূর্ব মায়াময় দৃশ্য। হাওরে প্রতিটি গ্রামেই করচ গাছ প্রচুর দেখা যেত। এখন মানুষ বিভিন্ন কারণে গাছ কেটে ফেলে, গাছ লাগালে নতুন করে আবার গাছ লাগাতে হয়, গাছের যত্ন নিতে হয়, এ বিষয়ে মানুষের সচেতনতা কম। অনেক গাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে, লাগাতে হয় না, কিন্তু মানুষ যদি তা কেটে ফেলে তবে একসময় এই গাছগুলো আর দেখা যাবে না, কেবল নামগুলো বইয়ের পাতায় দেখা যাবে। এ রকম করচ আর আমার গ্রাম নিয়ে আমার লেখাটি।
ঠিক এরকমই একটি করচ গাছের নীচে ঠিক একইরকম খালটি ছিল, ঠিক একরম করচ গাছের নীচেই সাঁকোটি ছিল। বাঁশের সাঁকো। সাঁকোর এপাশে ভেসে থাকা গাছের গুঁড়িতে বসে হিরু মিয়া বঁড়শী দিয়ে মাছ ধরত। আর আমি ঘাসের উপর বসে দস্যু বনহুর পড়তাম। মনিরার দুঃখে কাঁদতাম, আর হিরু মিয়া বলত, “রুবি’পা ওই দেখ মাছটা টোপের পাশে ঘুরাঘুরি করছে, এই যে টোপ গিলছে, এই যাহ্ টোপটা খেয়ে মাছটা পালালো”। কখনো আমি অন্য বইও পড়তাম। স্কুলের লাইব্রেরী থেকে আনা বই, যা আমার চাচাতো ভাই এনে দিত।
আমার বই পড়ায় হিরু মিয়া তেমন কিছু বলত না, তবে সে চাইত এর চেয়ে আমরা দুজনে মিলে শুকনো গর্ত সেঁচে শিং মাছ ধরি। ওই খালের পাশে একটা পুকুরও আছে। সেই পুকুরে ডুব দিয়ে হিরু মিয়া মাছ ধরত। হিরু মিয়া আর আমার গ্রাম্যজীবন খুবই স্বল্প দিনের, কিন্তু আমার স্মৃতিতে সবচেয়ে উজ্জ্বল। আমরা একসাথে বসে গান শুনতাম, হিরু মিয়া আমাকে তার সব কথাই বলত। আমরা বাঁশঝাড়ে গিয়ে ঘুঘু আর দোয়েলের বাসা খুঁজে বেড়াতাম, বাসা খুঁজে পেলে তাতে ডিম আছে কিনা খুঁজে দেখতাম। সে আমার চারমাসের ছোট চাচাতো ভাই ছিল। আমাকে সে সবার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিত। বড় অসময়ে চলে গেল হিরু মিয়া, আর আমাকে দিয়ে গেল গ্রামীণ একটা জীবনের মধুর শৈশব।
এই করচ গাছের ছায়া খালটিকে সারাদিন ঢেকে রাখত, এখন আগের মত গাছগুলো নেই। গ্রামটাই আর আগের মত নেই। আমি যখন ওখানে যাই, মাঠের পাশে খেতের আলে দাঁড়িয়ে আমার ছোটবেলার গ্রামটিকে খুঁজি। ভাবি হিরু মিয়া এসে বলবে, ” রুবি’পা, চল দেখবে বাঁশ ফুল, বাঁশে বহু বছর পর পর ফুল আসে, চল দেখবে।”
হিরু মিয়া আসে না, আমার ছেলেবেলার লুকোচুরি খেলা, মাঠে আগুন জ্বালিয়ে শীতে তাপ পোহানো, সব যেন একের পর এক আসতে থাকে ভাসতে থাকে।
আমার গ্রামের যে পাঠশালা, মেঠোপথ পেরিয়ে, বর্ষায় কাদাজল মাড়িয়ে যেতে হত। বৃষ্টি নামলে ছাতা তো ছিল না, ছিল কচু বা কলার পাতা। সেই পাতাই ছিল আমাদের ছাতা। বইগুলো বাঁচাতে পারলেই হত। আমরা তো মনের আনন্দে ভিজতেই চাইতাম।
সেই মধুর দিন, বৃষ্টি ভেজার দিন, মাঠে দৌড়ানোর দিন আজ আর নেই। ছেলেমেয়েরা মাছ ধরতে ভুলে গেছে, বৃষ্টি ভেজার আনন্দ নেই। গল্পের বই পড়ার সময় নেই। ক্লাসের বই পড়া, আর ইলেকট্রনিকস ডিভাইসে খেলা, মাঝেমধ্যে বাবা-মার সঙ্গে বন্দী পাখি হয়ে বেড়ানো -এই হল আজকের শৈশব।
বাংলাদেশের সব গ্রামই এক রকম ছিল দেখতে, একইরকম। এখন গ্রামগুলো আর আগের গ্রামের মত নেই। আমরা যারা আগের গ্রাম দেখেছি, আমাদের মন পড়ে থাকে আগের সেই গ্রামে। এখনকার গ্রাম আমাদের মনে লাগে না, কেমন যেন কৃত্রিমতার ছোঁয়া লেগে গেছে সহজ সরল পাখিডাকা সেই গ্রামেও। সবকিছু বদলে যায় সময়ের সাথে, মানুষও বদলে যাচ্ছে। মানুষ হারিয়ে ফেলছে মানবিক অনুভূতিগুলো। প্রকৃতি বদলে গেলে, মানুষ বদলাবে না, তা কী করে হয়!
এখন প্রকৃতি ও মানুষ উভয়েই বদলে গেছে।
এটি রুবি বিনতে মনোয়ারের লেখা গল্প। আপনার গল্পটি লিখে পাঠান আমাদের ইমেইলে-যা দৈনিক বিদ্যালয়ে আপনার ছবি সহ প্রকাশিত হবে। লিখে পাঠাতে dainikbidyaloy@gmail.com
আরো পড়ুনঃ মাংস তরকারিতে লবণ বেশি হলে করণীয়
ভারতের রাজ পরিবারের একটি অসাধারণ গল্প