গণিত অলিম্পিয়াড : রুবি বিনতে মনোয়ার

প্রশিক্ষণ

গণনা ও সংখ্যা আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সম্প্রতি মুক্তপাঠ এ গণিত অলিম্পিয়াড কোর্সটির আয়োজন প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে তুমুল হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। গণিত শিক্ষাকে ভীতিহীন ও চিত্তাকর্ষক করতে এর জুড়ি নেই। চমৎকার সব আইডিয়ার মাধ্যমে কোর্সটিকে প্রাণবন্ত ও বোধগম্য করে শিক্ষকদের মধ্যে তুলে ধরেছেন যারা কোর্সটি পরিচালনা করছেন। এজন্য আমাদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব এবং মহাপরিচালক কে এই কোর্সটি উপহার দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

মানুষের জীবন চলে গাণিতিক হিসেবে। আদিতে মানুষের গণনা বা সংখ্যার প্রয়োজন ছিল না, যেমন একটি শিশুর জন্মের পর পরই গণনা বা সংখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। শিশুটি যখন বড় হতে থাকে, তখন তার প্রয়োজনে তুলনা করতে শিখে; তেমনি মানুষ যখন কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রবেশ করল, তখনই সে তার প্রয়োজনে তুলনা করতে শিখল। তুলনার হাত ধরেই গণনার শুরু। কৃষিভিত্তিক সমাজে মানুষ পশুপালন করতে শিখল, তার কতগুলো পশু বেড়ে গেল, কতগুলো কমে গেল, এটা হিসেব রাখার দরকার পড়ল। কাঠি, দড়ির গিঁট বা পাথর দিয়ে এটা তারা করত। কখনও পশু হারিয়ে যেত, কখনও সংখ্যাটা বেড়ে যেত, বেড়ে যাওয়া মানে যোগ আর কমে যাওয়া মানে বিয়োগ এই ধারণাটা তখনকার। বিনিময় প্রথা শুরুর পর বিয়োগের লিখিত রূপ আসে। ভারত, আরব, রোমান সভ্যতার বিয়োগের চিহ্ন ভিন্ন ভিন্ন ছিল। বর্তমান বিয়োগের চিহ্ন এসেছে জার্মান থেকে।

মিসরীয় সভ্যতায় মানুষের নির্মাণ ও বাণিজ্যের প্রয়োজনে বড় বড় হিসেবের প্রয়োজন পড়ত, ক্রমান্বয়ে যোগ ও দ্বিগুণ করার মাধ্যমে হিসেবের কাজটি তারা করত। গুণ হল বার বার যোগ করার বৃদ্ধি। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মানুষেরা গুণটেবিল ব্যবহার করত। বর্তমানের গুণ করার পদ্ধতি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্তের আবিষ্কার।

ভাগের প্রাথমিক ধারণা শুরু হয় বন্টনের ধারণা থেকে। মানুষ যখন যৌথ সমাজে বাস করত, তখন তারা যা কিছু উৎপাদন করত, তা এক জায়গায় জড়ো করত, সমাজের নেতা তা বন্টন করতেন। আজ থেকে ৪০০ বছর আগে ভাগের প্রক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ছিল। ভাগ হচ্ছে দ্রুত বিয়োগের একটি কৈশল। এটি প্রথম করে দেখান বিখ্যাত গণিতবিদ জন নেপিয়ার। কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে মানুষের জমির পরিমাপ, বীজের পরিমাপ, ফসলের দূরত্ব, গাছের দূরত্ব এসব জানার জন্য প্রথমে তুলনার সাহায্য নিলেও পরে ধীরে ধীরে পরিমাপ পদ্ধতি আবিষ্কার করে।

READ MORE  প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য সময় ও সুযোগ বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ

আরও পড়ুন: সমন্বিত নিয়োগ বিধি ২০২০ পদোন্নতি ও জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে প্রাসঙ্গিক ভাবনা

মানুষের কথা বলতে শেখা এবং গণনা ও সংখ্যার ব্যবহার প্রায় একই সাথেই শুরু হয়। আদি মানুষ কেবল ধ্বনির অব্যক্ত আওয়াজ করতে পারত, সে একাই চলতে পারত, যৌথ সমাজে প্রবেশের মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরী হওয়া ভাব বিনিময়ের প্রয়োজন হতেই যেমন বর্ণ, শব্দ তথা কথার সৃষ্টি, তেমনি পারস্পরিক বিনিময়ের প্রয়োজনে গণনার শুরু।
আধুনিক যুগে পদার্পণ গণিতের অসামান্য অবদান।

কোমলমতি শিশু বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে গণিত বিষয়টি আয়ত্ত না করতে পারলে শিশুরা গণিতভীতিতে থাকে, স্কুল পালায়, ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পায়।

গণিত অলিম্পিয়াডে যে সকল কলাকৌশল আলোচিত হয়েছে তা একটু দেখে নিই।

গণনা ও সংখ্যার ধারণা পেতে পাঁচটি আইডিয়া ব্যবহার করা হয়েছে:
১। আঙ্গুল গণনা
২। নম্বর বল
৩। কাগজের বাস্কেট বল
৪। নম্বর উইন্ডো
৫। নম্বর পাজল।

তুলনার ধারণা পেতে ব্যবহৃত হয়েছে নিচের ধারণাগুলো
১। কাগজের ঘর (বড়-ছোট তুলনা)
২। খাটো কাঠি, লম্বা কাঠি ( লম্বা-খাটো তুলনা)
৩। কাগজের এরোপ্লেন ( কাছে দূরে তুলনা)
যোগ বিয়োগের ধারণা পেতে যোগের ক্ষেত্রে বেড়ে য়াওয়া ও বিয়োগের ক্ষেত্রে কমে যাওয়া এই ধারণাটির উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

বিয়োগের আইডিয়াগুলো এমন:
১। হারানো বেলুন
২। উপকরণ ধরে বিয়োগ
৩। দশের দলে বিয়োগ
৪। এক গুটি দুই খেলোয়াড়
৫। যোগ বিয়োগের কার্ড

গুণের আইডিয়াগুলি এমন
১। গুণতে গুণতে গুণ
২। ডমিনোর গুণ
৩। ডমিনোর নামতা
৪। সিক্রেট ডোর

ভাগের ধারণা
১। মার্বেল ভাগাভাগি
২। স্ট্যান্ডআপ
ভগ্নাংশের আইডিয়া
১। বস্তুর উপকরণ অর্ধেক চিনি
২। নানানভাবে এক চতুর্থাংশ চিনি
৩। অর্ধেক ও এক চতুর্থাংশের তুলনা

মুদ্রার আইডিয়া
১। মুদ্রা পরিচয়
২। পাজলে কেনাবেচা
৩। খুচরো টাকার খেলা

READ MORE  শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানা গেছে

পরিমাপের আইডিয়া
১। কাগজের স্কেল
২। দড়িতে মিটার স্কেল
৩। সেন্টিমিটার দৌড়
৪। বাটখারার যোগ

জ্যামিতির আইডিয়া
১। অরিগ্যামি (origami জাপানী শব্দ। ori অর্থ ভাজ করা, kami অর্থ কাগজ। অরিক্যামী শব্দটি পরে অরিগ্যামী হয়ে যায়)
২।তাঁদের চেন নাকি
৩। আকৃতির ছবি আঁকি
৪। কাগজের কোলাজ
৫। ট্যানগ্রাম (বর্গাকৃতি কাগজকে সাত টুকরো করে এর মধ্য দিয়ে বস্তুর আকৃতি ও সংখ্যা তৈরি করা।)

গণিত অলিম্পিয়াড আসলেই শিক্ষকদের মধ্যে উৎসবের আমেজ এনে দিয়েছে। সবাই এখন মুক্তপাঠে রেজিষ্ট্রেশন করছেন। সার্ভারের সমস্যায় প্রচুর ধৈর্য ধরে কোর্স সমাপ্ত করছেন। কোর্সটি থেকে প্রাপ্ত আইডিয়াগুলি স্কুলে কাজে লাগাতে পারলে গণিত শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক হবে, ঝরে পড়া রোধে এটি ব্যপক ভূমিকা পালন করবে।

আরো পড়ুন: জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ও শিক্ষকদের পদোন্নতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *